স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। একটি স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ জাতি দেশের সার্বিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধন রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য হিসেবে স্বীকৃত। এই অঙ্গীকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বাংলাদেশ সরকার সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে স্বাস্থ্যখাতকে অগ্রাধিকার খাত হিসেবে গ্রহণ করেছে। গত দুই দশকে এ খাতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। প্রজনন হার ও মৃত্যু হার হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, নবজাত শিশু ও মাতৃ-মৃত্যু হ্রাসের পাশাপাশি চিকিৎসা সেবার আধুনিকায়নে ও প্রসারের ক্ষেত্রে বিনিয়োগের মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন ও নতুন অবকাঠামো স্থাপন অব্যাহত রয়েছে। জনগণের প্রত্যাশা ও সরকারি সম্পদের দিকে লক্ষ্য রেখে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি ও মান বৃদ্ধি করা হচ্ছে। বর্তমান সরকার দেশের সকল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হচ্ছে- দেশের সকল মানুষের বিশেষ করে নারী, শিশু ও দরিদ্র জনসাধারণের জন্য যথাযথ মানসম্পন্ন মৌলিক স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা নিশ্চিত করা।
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। এই গ্রামাঞ্চলে এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তার নেই বললেই চলে, ফলে গ্রাম পর্যায়ের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার জন্যে পল্লী চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে হয়। পল্লী চিকিৎসক বা গ্রাম ডাক্তারগণ গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় তাৎপর্যপূর্ণ ভুমিকা পালন করছেন। যথা-
(১) দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ বাড়ির দোরগোড়ায় অত্যাবশ্যকীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পল্লী চিকিৎসকদের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন।
(২) গ্রামের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে পল্লী চিকিৎসকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন।
(৩) স্বাস্থ্য বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমেও পল্লী চিকিৎসকগণ স্বাস্থ্য সেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
(৪) প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, সংক্রমক রোগ প্রতিরোধ, যক্ষ্মা রোগ সনাক্তকরণ ও চিকিৎসা, অপুষ্টিজনিত রোগের চিকিৎসা, যৌনবাহিত রোগের চিকিৎসা, এইচআইভি/এইডস সনাক্তকরণ, সকল প্রকার সাধারণ রোগের চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে পল্লী চিকিৎসকগণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।
(৫) আমাদের দেশে এমবিবিএস পাশ করা ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, সেক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থায় পল্লী চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
(৬) দ্রুততম সময়ের মধ্যে তৃণমূল জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পল্লী চিকিৎসকগণ ভূমিকা রাখতে পারে।
পল্লী চিকিৎসকদের ন্যূনতম এসএসসি পাশ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো উচিত। এতে পল্লী চিকিৎসকদের মর্যাদা বাড়বে এবং মানুষের সু-চিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে অনেক উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিগণও পল্লী চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন, তাদেরকেও প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্তমানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। চিকিৎসা পেশা অন্যান্য পেশার তুলনায় স্পর্শকাতর এবং শারীরিক ও মানসিক কষ্ট বা অসুস্থতা তথা জীবন-মৃত্যুর সমস্যার সঙ্গে জড়িত হওয়ায় ন্যূনতম শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া এই পেশায় নিয়োজিত হওয়া উচিত না। এই বিষয়ে সরকার আগ্রহী ও উপযুক্ত ব্যক্তিদেরকে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে পল্লী চিকিৎসক তৈরীর মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেন।
২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচির তালিকায় স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবার কল্যাণ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি ছিল (১১.১) সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পূর্বতন আওয়ামী লীগ সরকারের (১৯৯৬-২০০১) প্রণীত জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি পুনর্মূল্যায়ন করে যুগের চাহিদা অনুযায়ী নবায়ন করা হবে। এই নীতির আলোকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক চালু, পুষ্টি, শিশু ও মাতৃমঙ্গল নিশ্চিত করা হবে। জনসংখ্যানীতি যুগোপযোগী করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। উল্লেখ্য যে, সরকারের মেয়াদের অর্ধেক সময় শেষ হলেও সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলো এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি তবে প্রক্রিয়াধীন বা চুড়ান্ত হওয়ার পথে রয়েছে বলে জানা যায়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়নের কাজ চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
গত ৩০ মে মন্ত্রিসভায় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির খসড়া অনুমোদন হয়েছে। এখন তা সংসদে উত্থাপনের পর্যায়ে রয়েছে। বর্তমান সরকার এ পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে কার্যক্রম চালু করেছে। এ সব কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য ১৩ হাজার ৫০০ কমিউনিটি হেলথকেয়ার প্রোভাইডার নিয়োগের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা যায়। তবে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক পুরোপুরি চালু করা প্রয়োজন। কারণ দেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী শতকরা ৮৫ ভাগ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পল্লী চিকিৎসক ও কমিউনিটি ক্লিনিকের ভূমিকা ব্যাপক।
আমাদের দেশে স্বাস্থ্য খাতে যথেষ্ট নেতিবাচক চিত্র বিদ্যমান। একদিকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্পদ ও সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা অন্যদিকে সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে নানা ধরণের অনিয়মের কারণে সেবা গ্রহীতারা অনেক ক্ষেত্রেই কাক্মিখত সেবা প্রাপ্তি হতে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবার প্রতি জনসাধারণের একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়েছে। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া জরুরি।
মানুষ সরকারি কিংবা বেসরকারি হাসপাতাল হতে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি ও অনিয়মের শিকার হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিকসহ স্বাস্থ্যসেবার সকল স্তর থেকে দুর্নীতি ও অনিয়ম দূর করতে হবে। দেশের সকল মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে এই খাতের সকল দুর্নীতি ও অনিয়মের অবসান করতে হবে। বর্তমান বিদ্যমান আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে নতুন আইন তৈরি করতে হবে।
স্বাস্থ্যসেবায় চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টদের মানবিক হতে হবে। সকলকে স্ব-স্বক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগসহ সকল ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
একটি সুস্থ সবল জনগোষ্ঠীই শুধু দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এ জন্যে প্রয়োজন স্বাস্থ্য সচেতনতা, রোগ প্রতিরোধমূলক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ এবং যথাযথ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যসেবা। সে লক্ষ্যে যথাযথ কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সরকার ও সংশ্লিষ্টগণ আরো সচেষ্ট হবেন বলে আশা করছি।